ছড়া কবিতা, ছোটদের ছড়া কবিতা, সেরা বাংলা চিরায়িত ছড়া: ছড়া বাংলা সাহিত্যের একটি প্রাচীন ধারা। অনেকে একে ছোটদের কবিতা বা ছড়া কবিতাও বলে থাকে। মূলত ছড়ার মাধ্যমেই প্রতিটি বাঙ্গালীর সন্তানেরা সাহিত্যের সাথে পরিচয় হয়। স্বরবৃত্ত এবং ছন্দ-মিলে রচিত আদিমতম বাকশিল্প এবং লোক সাহিত্যের একটি বলিষ্ঠ অধ্যায়। ছড়া বলতে আমরা বুঝি মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত বিশেষ কবিতা। ধারণা করা হয় সংস্কৃত ছট্ শব্দের থেকে ছড়া শব্দটি এসেছে। যার অর্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। প্রাচীন লোক সাহিত্যের অন্তর্মূলে ছড়ার জন্ম, লালন ও বিকাশ। ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক বলেন ‘ ছড়া হল বঙ্গীয় লোকসাধারণের সর্বপ্রকার প্রকাশভঙ্গির একটি সর্বজন স্বীকৃত চিরাচরিত ভঙ্গি; সেটিকে নারী ও পুরুষ আপন আপন প্রয়োজনে গ্রহণ করেছে। ‘অর্থাৎ ছড়া হলো একেবারে প্রান্তিক মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত এবং তাদের জীবন বোধেরই এক সার্বজনীন প্রকাশভঙ্গী। তাদের জীবনের নানা ঘটনার প্রকাশ ঘটেছে ছড়ার মাধ্যমে। ড. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছড়ার সজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেন ‘ কোন বিষয় লইয়া রচিত গ্রাম্য কবিতা, সংস্কৃত ছটা, প্রাকৃত ছড়া।’ অর্থাৎ সমাজ জীবনের যে কোনো বিষয় তথা ঘটনাবলি যখন কবিতা আকারে প্রকাশিত হয় কিংবা জনসাধারণের মনের ভাব যখন কবিতা আকারে প্রকাশিত হয় তাই ছড়া। তিনি তার সজ্ঞায়ে ছড়ার উৎপত্তি সংক্রান্ত বিষয়েও আলোকপাত করছেন। তার মতে সংস্কৃত ছটা শব্দটি থেকে বাংলা ছড়ার উৎপত্তি। বিখ্যাত ভাষা তাত্ত্বিক ও সাহিত্য বিশারদ সুকুমার সেন ছড়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন লোক সাহিত্যের যে শাখাটি অন্তঃপুরের আঙিনায় স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছে তা ঘুমপাড়ানি ও ছেলে ভোলানো ছড়া। সুকুমার সেনের এই বক্তব্যে আমরা ছড়ার প্রকারভেদ সম্পর্কেও ধারণা পাই। তার মতে ছড়া মুলত দুই ধরনের হতে পারে। ১. ঘুমপাড়ানি ছড়া। ২. ছেলে ভুলানো ছড়া। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছড়া কবিতা’র ধারণা দিতে গিয়ে বলেছেন ” গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাঁচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়: প্রথমত ছড়া হবে সহজ ও সাবলীল ভাষায় রচিত সুরময় সাহিত্যকর্ম। দ্বিতীয়ত ছড়ার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
ছোটদের ছড়া কবিতা:
ছড়ার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারনা পাওয়া যায় ড. ওয়াকিল আহমেদের আলোচনায়। ড. ওয়াকিল আহমদের মতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গুলো হল: ১. ছড়া- মূলত আবেগ অনুভূতিজাত বুদ্ধিপ্রসূত নয়। ২. ছড়া চর্চায় সব বয়সের নর-নারীর অংশগ্রহণ করে। ৩. ছড়ায় বিষয় বৈচিত্র্য আছে লঘুগুরু সব ধরনের বিষয় এবং হাস্য-নি ব্যঙ্গ করুণ-শান্ত নানা ধরনের রস নিয়ে ছড়া হয়। ৪. ছড়ার নিজস্ব ছন্দ আছে যা ‘ছড়ার ছন্দ’ বা ‘স্বরবৃত্ত ছন্দ’ নামে পরিচিত। ৫. ছড়া আবৃত্তি সুখকর। ৬. ছড়ার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি সহজ-সরল প্রত্যক্ষ; কৃচিৎ হেঁয়ালির ভাষা ব্যবহৃত হয়। ৭. ছড়া চিত্রবহুল ও ধ্বনি স্পন্দিত বলে স্মৃতিতে ধরে রাখা সহজ হয়। ৮. ছড়া চিত্তবিনােদনের নির্মল মাধ্যম; কোনো কোনো ছড়ায় গ্রাম্যতা থাকলেও অশ্লীলতা নেই। ৯. ছড়ার মধ্যে ‘চিরত্ব’ আছে। পৃথিবীর সব দেশে সব সমাজে ছড়া আছে; এই সর্বজনীনতার ও সর্বকালীনতার গুণে ছড়া পুরাতন হয়েও চির নতুন। ১০. ছড়া জীবন্ত ও আন্তর্জাতিক। ছড়ার জন্ম ও বিকাশের ইতিহাস প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো। বলা যায় বাংলা সাহিত্যের আদি সৃষ্টি স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা এসব ছড়া। সে সময় সাহিত্য চর্চা হতো মুখে মুখে এবং ছড়া কবিতা-ই ছিলো সাহিত্যের প্রথম শাখা। সেই সময় থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন ছড়া টিকে আছে লোকমুখে। লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থ রুপদেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার। খুকুমণির ছড়া নামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং এই গ্রন্থটির ভুমিকা রচনা করেন রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীই প্রথম ছড়াতে সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে সুকুমার রায়ের ছড়াকে সংকলনের মাধ্যমে সাহিত্যের শাখা হিসেবে ছড়াকে আরো শক্তিশালী করেন। এসময় কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জসিমউদদীন প্রমুখ ছড়া রচনা করে বাংলা সাহিত্যে ছড়াকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। লৌকিক জীবনযাত্রার ইতিকথা নিহিত রয়েছে এই সব ছড়ার মাঝেই। বলা হয়ে থাকে ইতিহাস শুধু রাজা রানীদের কথা বলে কিন্তু এই ছড়াগুলি বলে সাধারণ মানুষের কথা। তাই বাংলার লোকসমাজ জানতে গেলে তার উপাদান হিসেবে অবশ্য পাঠ্য বিষয় হয়ে দাড়ায় ছড়া। এ কারণে ছড়ার সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।